হযরত মুসা (আ.)

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - আদর্শ জীবন চরিত | | NCTB BOOK
18
18

হযরত মুসা (আ.)

জোড়ায় কাজ

'হযরত মুসা (আ.) এবং হযরত আলি (রা.)-এর জীবনাদর্শ হলো আল্লাহর অনুগত্যে পরিপূর্ণ'

উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে হযরত মুসা (আ.) এবং হযরত আলি (রা.)-এর জীবনাদর্শ কোন দিকগুলোতে আল্লাহর অনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে তা তোমার সহপাঠীর সাথে আলোচনা করে খুঁজে বের করো।

পেন্টাটিউক প্রাচীন মিসরের রাজধানী, নীল নদের তীরের একটি নগরী। এই নগরীর শেষ প্রান্তে বসবাস করত বনি ইসরাইল বংশের লোকেরা। নগরীর সম্রাটদের 'ফির'আউন' বলা হতো। মুসা (আ.)-এর সমসাময়িক ফির'আউনের নাম ছিল ওয়ালিদ ইবনে মুসআব। তাকে 'দ্বিতীয় রামেসিস'ও বলা হয়। সে বনি ইসরাইল বংশের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিল। কারণ, ফির'আউন একবার স্বপ্নে দেখে যে, 'বায়তুল মুকাদ্দাস' থেকে একঝলক আগুন এসে মিসরকে গ্রাস করে ফেলেছে এবং তার অনুসারী 'কিবতি' সম্প্রদায়কে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বনি ইসরাইলদের কোনো ক্ষতি করছে না। ফির'আউন তার রাজ্যের সকল স্বপ্নবিশারদ থেকে একসঙ্গে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চায়। তারা বলল, ইসরাইল বংশে এমন এক পুত্রসন্তানের আগমন হবে, যে আপনাকে ও আপনার রাজত্বকে ধ্বংস করে দেবে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে ফির'আউন ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ফির'আউন সেনাবাহিনীকে আদেশ দিল যে, বনি ইসরাইল বংশে যত পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, সবাইকে যেন হত্যা করা হয়। তাই সে সময় ফির'আউনের সেনাবাহিনীরা ঘুরে বেড়াত। কেউ জন্মগ্রহণ করলেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করত। এভাবে অসংখ্য ইসরাইলি পুত্রসন্তান নিহত হয়। 

হযরত মুসা (আ.)-এর জন্ম

এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পিতা ইমরান আর মা ইউকাবাদের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন শিশু মুসা (আ.)। জন্মের পরপরই তাঁর মা খুব বিচলিত হয়ে পড়েন। শিশুসন্তানকে বাঁচাতে অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েন। হযরত মুসা (আ.)-কে তাঁর মা তিন মাস গোপনে লালন-পালন করলেন। তখন আল্লাহ তা'আলা তাকে জানিয়ে দিলেন, তিনি যেন একটি বাক্সে ভরে মুসা (আ.)-কে নদীতে ভাসিয়ে দেন। আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ অনুযায়ী তিনি কাঠের বাক্স বানিয়ে শিশু মুসাকে নদীতে ভাসিয়ে দেন। সেই কাঠের বাক্স ভাসতে ভাসতে ফির'আউনের প্রাসাদ ঘাটে গিয়ে ভিড়লো। কয়েকজন দাসী এসে তা তুলে নিয়ে ফির'আউন এবং তার স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুজাহিম-এর সামনে পেশ করল।

হযরত আসিয়া (রা.) বাক্সটা খোলার পর হযরত মুসা (আ.)-কে দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি শিশুটিকে নিজের ছেলে হিসেবে রাখতে চাইলেন। কিন্তু বিপত্তি বাধাল ফির'আউন। সে তাকে হত্যা করতে চাইল। তার মনে প্রবল সন্দেহ হলো- এ শিশুটি বনী ইসরাইলের কেউ হবে। হতে পারে এই সে-ই, যার জন্য অসংখ্য শিশুকে সে হত্যা করেছে। কিন্তু হযরত আসিয়া (আ.) যুক্তি দিয়ে বললেন, 'সে হয়তো আমাদের চোখের শীতলতা হবে। তাঁকে হত্যা করবেন না। আমরা তাকে আমাদের সন্তানের মতো করে গড়ে নেব।' ফির'আউন তার কথা মেনে নিল।

হযরত মুসা (আ.)-এর শৈশবকাল

হযরত মুসা (আ.)-কে দুধপান করানো নিয়ে বেশ জটিলতায় পড়লেন আসিয়া (আ.)। ক'জন ধাত্রীকে আনা হলো, অথচ তিনি কারো স্তন্যপান করলেন না। এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন মুসা (আ.)-এর বোন মরিয়ম। সে বলল, 'আমি একজন ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি। সে অতি যত্নের সঙ্গে তাকে লালন করবে এবং আমি আশাবাদী সে তাঁর দুধ পান করবে।' এভাবেই মুসা (আ.) তাঁর মায়ের কোলেই রাজ প্রাসাদে লালিত-পালিত হলেন। আল্লাহ তা'আলা তাঁর মায়ের অন্তরে প্রশান্তি দান করলেন।

ফির'আউন শিশু মুসা (আ.)-কে কোলে নিলেন। তখন শিশু মুসা (আ.) ফির'আউনের গালে প্রচণ্ড জোরে চড় মারেন। এই ঘটনায় ফেরাউন বেশ চটে যায়। সে মুসা (আ.)-কে হত্যা করতে চাইল এবং বলল, এই সেই শিশু, যে আমার রাজত্ব ধ্বংস করবে। তখন আসিয়া (আ.) বুঝালেন, এটা নিতান্তই শিশুসুলভ আচরণ। আপনি তাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আসিয়া (আ.)-এর কথামতো পরীক্ষার আয়োজন করা হলো। এক পাত্রে মণিমুক্তা আরেক পাত্রে আগুনের অঙ্গার রাখা হলো। মুসা (আ.)-কে ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি মণিমুক্তার দিকে গেলেও জিবরাইল (আ.) তাঁকে অঙ্গারের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। তখন আগুন মুখে নেওয়ায় তার মুখে জড়তা তৈরি হয়।

হযরত মুসা (আ.)-এর হিজরত

হযরত মুসা (আ.) একবার দেখতে পেলেন যে, একজন কিবতি জনৈক ইসরাইলিকে অত্যাচার করছে। তিনি অত্যাচারিত লোকটিকে বাঁচানোর জন্য অত্যাচারী কিবতি লোকটিকে একটি ঘুষি মারলেন। এতে লোকটি মারা যায়। হযরত মুসা (আ.) তখন প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে স্বদেশ ত্যাগ করলেন। তিনি যাত্রা শুরু করলেন মাদইয়ানের উদ্দেশ্যে।

তিনি মাদইয়ানের একটি মরুদ্যানে পৌছাতে সক্ষম হলেন। নিজের কর্মদক্ষতায় তিনি দু'জন অপেক্ষমাণ রমণীকে পানি সংগ্রহ করে দিলেন। তাদের মাধ্যমে হযরত মুসা (আ.) সাক্ষাৎ পেলেন হযরত শুয়াইব (আ.)- এর। হযরত মুসা (আ.) তাঁর সান্নিধ্যে ১০ বছর অতিবাহিত করেন। হযরত শুয়াইব (আ.) তাঁর কর্মদক্ষতা, চারিত্রিক মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা সফুরাকে তাঁর সঙ্গে বিবাহ দেন।

নবুওয়াত লাভ

দীর্ঘ দশ বছর পর হযরত মুসা (আ.) মাদইয়ান থেকে মিসরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও একপাল বকরি। তুর পাহাড়ের পাদদেশে আসার পর সন্ধ্যা হয়ে যায়। রাত্রিযাপনের জন্য তিনি পাহাড়ের নিকটে 'তুয়া' নামক পবিত্র উপত্যকায় তাঁবু স্থাপন করেন এবং সেখানে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন। নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে দিয়েছিলেন অসংখ্য মু'জিযা। তার মধ্যে অন্যতম হলো হাতের লাঠি সাপে পরিণত হওয়া ও হাতের শুভ্রতা। আল্লাহ তা'আলা হযরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে সরাসরি ও ফেরেশতাদের মাধ্যমে কথাবার্তা বলতেন। আর এ কারণে তাঁকে 'কালিমুল্লাহ' তথা আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথনকারী বলা হয়।

দ্বীনের দাওয়াত

নবুওয়াত লাভের পর হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীন প্রচারের জন্য আদিষ্ট হন। হযরত মুসা (আ.) তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় ফির'আউনের রাজ প্রাসাদে কাটিয়েছেন। শৈশবে মুখ পুড়ে যাওয়ার কারণে তাঁর মুখে জড়তা সৃষ্টি হয়। অথচ নবুওয়াতের কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য বিশুদ্ধভাষী হওয়া জরুরি। তাই তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালেন, 'হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন এবং আমার জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দিন!' আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রার্থনা কবুল করলেন এবং অতিসত্বর মিসরে যাওয়ার আদেশ দিলেন। হযরত মুসা (আ.) হযরত হারুন (আ.)-কে নিয়ে ফির'আউনের কাছে যান এবং দ্বীনের দাওয়াত দেন।

হযরত মুসা (আ.) ফির'আউনকে তাঁর মু'জিযাগুলো দেখালেন এবং তাকে আল্লাহ তা'আলার প্রতি ইমান আনার আহ্বান জানালেন। ফির'আউন এতে কর্ণপাত করল না। উপরন্তু সে হযরত মুসা (আ.)-কে যাদুর চ্যালেঞ্জ দিল।

যাদুমঞ্চ ও যাদুকরদের ইমান গ্রহণ

বিশাল মাঠে যাদু দেখানোর আয়োজন করা হলো। অনেক বেশি লোকসমাগম হলো। দেশের সবচেয়ে দক্ষ যাদুকররা এলো। সেই বিশাল জনসভায় মুসা (আ.) দৃপ্তকণ্ঠে বললেন, 'দুর্ভাগ্য তোমাদের; তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না। তাহলে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেবেন। যে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, সে-ই ব্যর্থ হয়েছে।' মুসা (আ.)-এর কথা শুনে তারা বিস্মিত হয়ে পরস্পর পরামর্শ করল। তারপর মুসা (আ.)-কে লক্ষ্য করে বলল, তুমিই আগে শুরু করবে নাকি আমরা? তিনি বললেন, 'তোমরাই আগে শুরু করো। যাদুকররা তাদের লাঠি আর দড়ি জমিনে নিক্ষেপ করল। সেগুলো যাদুর প্রভাবে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করল। তখন আল্লাহ তা'আলা মুসা (আ.)-কে অভয় দিয়ে বলেন, ভয় করো না, তুমিই বিজয়ী হবে। তোমার ডান হাতে যা আছে তুমি তা নিক্ষেপ করো। এটা যা কিছু তারা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে। তারা যা করেছে তা তো কেবল যাদুকরের কলাকৌশল। যাদুকর যেখানেই থাকুক, সফল হবে না। (সূরা ত্বহা, আয়াত: ৬৫-৭০) মুসা (আ.) যখন তাঁর লাঠি জমিনে নিক্ষেপ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে সেটি বিরাট অজগর হয়ে মাঠের সবগুলো সাপ গ্রাস করে ফেলল। যাদুকররা বুঝতে পারল, এ নিছক যাদু নয়। তারা সকলেই তখন সিজদায় অবনত হয়ে ইমান আনল।

ফির'আউনের পরিণতি

ফির'আউন যখন ইমান আনল না এবং বনি ইসরাইলকেও তার দাসত্ব হতে মুক্তি দিল না, তখন আল্লাহ তা'আলা মুসা (আ.)-কে মিসর ত্যাগ করার আদেশ দেন। রাতের অন্ধকারে মুসা (আ.) বনি ইসরাইলকে নিয়ে বের হয়ে পড়েন। ফির'আউন হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর দলবলের মিসর ত্যাগের খবর শুনে সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাঁদের পেছনে ছুটল। হযরত মুসা (আ.) তাঁর দলবল নিয়ে লোহিত সাগরের তীরে এসে থমকে দাঁড়ালেন। অন্যদিকে ফির'আউন তার সৈন্যবাহিনীসহ তাঁদের খুব কাছাকাছি চলে এলো। তখন মুসা (আ.)-এর অনুসারীরা ভয় পেয়ে গেল। মুসা (আ.) তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই আমার রব আমাদের পথ দেখাবেন। আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুসা (আ.) তাঁর লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত করলেন। সাগরের পানিতে রাস্তা তৈরি হলো। বনি ইসরাইলের ১২টি দলের জন্য ১২টি পথ হয়ে গেল। হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা নিরাপদে নদী অতিক্রম করলেন। ফির'আউন ও তার সৈন্যবাহিনী হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের সাগর পার হতে দেখে তাঁদের অনুসরণ করল। যখন তারা সাগরের মাঝখানে পৌঁছল, তখনি রাস্তা সাগরের পানিতে মিশে গেল। ফলে ফির'আউন তার দলবলসহ ডুবে মরল। আল্লাহর নবিকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেরাই ধ্বংস হলো। আর এভাবে সত্যের জয় হলো

তাওরাত লাভ

আল্লাহ তা'আলা হযরত মুসা (আ.)-কে তাওরাত কিতাব দেওয়ার অঙ্গীকার করলেন। তিনি আল্লাহর আদেশে তাওরাত কিতাব আনতে তুর পাহাড়ে গেলেন। সেখানে ৩০ দিন থাকার ইচ্ছা করলেন, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় আরো ১০ দিন বেশি অবস্থান করলেন। তুর পাহাড়ে হযরত মুসা (আ.) সাওম, ইতিকাফ ও কঠোর সাধনায় মগ্ন থাকতেন। তিনি তুর পাহাড়ে থাকাকালীন তাঁর ভাই হযরত হারুন (আ.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। এমতাবস্থায় তাঁর অনুসারীদের অনেকেই 'সামেরি' নামক এক ব্যক্তির ধোঁকায় পড়ে গরুর বাছুর পূজা শুরু করে। হযরত মুসা (আ.) তাওরাত কিতাব নিয়ে এসে তাদের এ অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হলেন। তখন তাওবা হিসেবে গরু বাছুর পূজারিদের একে অপরকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হলো। যার ফলে সত্তর হাজার বনি ইসরাইল নিহত হয়। হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.) আল্লাহর নিকট খুব কান্নাকাটি করেন। অবশেষে আল্লাহ তাদের মাফ করে দেন।

ইন্তিকাল

পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। হযরত মুসা (আ.)-ও এর ব্যতিক্রম নন। হযরত মুসা (আ.) ১২০ বছর বয়সে সিনাই উপত্যতায় ইন্তিকাল করেন। তাঁকে তুর পাহাড়ের পাদদেশে সমাহিত করা হয়। আমরা হযরত মুসা (আ.)-এর মতো নির্ভীক হয়ে সত্যের পথে মানুষকে ডাকব। সত্য ও ন্যায়ের পথ অনুসরণের মধ্যেই জীবনের সাফল্য নিহিত।

Content added By
Promotion